ভারতী ঘোষ একজন আইপিএস পুলিশ কর্মকর্তা ছিলেন। কর্মক্ষেত্র ছিল পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর জেলায়। এই পুলিশকর্তার দারুণ সম্পর্ক ছিল পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। ছিলেন পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার পুলিশ সুপার। রাজনীতিতে তাঁকে নিয়ে শুরু হয়েছে নতুন আলোড়ন।
ভারতী একটানা ছয় বছরের বেশি সময় ধরে দায়িত্ব পালন করেছেন এই জেলায়। তিনি ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অত্যন্ত কাছের লোক। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ‘মা’ বলে ডাকতেন। প্রকাশ্যেও তিনি মমতাকে মা সম্বোধন করতেন।
রাজনীতিকেরা বলেন, মমতার সঙ্গে ভারতী ঘোষের সুমধুর সম্পর্কের জেরেই পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা জুড়ে ছিল ভারতী ঘোষের একচ্ছত্র আধিপত্য। বিরোধীদের অভিযোগ, তিনি ছিলেন তৃণমূলের অপ্রকাশ্যের এক নেত্রীও। দলকে গোছানো, দলকে বাড়ানো, দল ভাঙা, কাউকে দলে আনা—এসবের দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। এর ফলে এই পশ্চিম মেদিনীপুরে বাড়বাড়ন্ত হয়েছিল তৃণমূল। এ জন্য তিনি ছিলেন মমতার নয়নমণি। শুধু কি তা-ই, ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচন এবং ২০১৬ সালের রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনের আগেই বিরোধী দলের চাপের মুখে ভারতী ঘোষকে ওই পদ থেকে সরিয়ে দেয় ভারতের নির্বাচন কমিশন। বদলি করে অন্যত্র। আবার নির্বাচন সম্পন্ন হওয়ার পর মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভারতী ঘোষকে স্বপদে ফিরিয়েও আনেন। এতে মমতা বা তৃণমূলের সঙ্গে ভারতী ঘোষের সুসম্পর্কের দিকটি স্পষ্ট হয়ে যায়।
আবার এই ভারতী ঘোষকে ২০১৪ সালের ১৫ আগস্ট ভারতের স্বাধীনতা দিবসে দেওয়া হয়েছিল মুখ্যমন্ত্রীর কমেন্ডেবল সার্ভিস মেডেলও। পশ্চিম মেদিনীপুরের পুলিশ সুপারের পাশাপাশি তাঁকে একসময় ঝাড়গ্রামের পুলিশ সুপারেরও অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল শুধু তাঁর কাজের স্বীকৃতির জন্য।
শুধু মমতা কেন, মমতার দলের সেই সময়কার দ্বিতীয় শক্তিশালী নেতা মুকুল রায়ের সঙ্গেও ছিল ভারতী ঘোষের সুসম্পর্ক। মমতা বা মুকুল রায়ের সঙ্গে এই সুসম্পর্কে ছেদ ঘটে মুকুল রায়ের বিজেপিতে যোগদানের পর। অভিযোগ ওঠে, মুকুল রায় বিজেপিতে যোগদানের পর ভারতী ঘোষ নাকি মুকুল রায়ের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতেন। এটা মেনে নিতে পারেননি মমতা বা পূর্ব মেদিনীপুরের তৃণমূল নেতা ও রাজ্যের এক প্রভাবশালী মন্ত্রী। এরপর শুরু হয় ওই মন্ত্রীর সঙ্গে ভারতী ঘোষের ঠান্ডাযুদ্ধ।
গত ২৬ ডিসেম্বর হঠাৎ করে ভারতী ঘোষের অনেকটা পদাবনতি ঘটিয়ে পুলিশ সুপারের পদ থেকে সরিয়ে তাঁকে বদলি করা হয় উত্তর ২৪ পরগনা জেলার ব্যারাকপুরের পুলিশের তৃতীয় ব্যাটালিয়নের কমান্ডিং অফিসার পদে। এটাই মেনে নিতে পারছিলেন না ভারতী ঘোষ। তিনি নতুন পদে যোগ না দিয়ে পদত্যাগ করেন। আবেদন করেন স্বেচ্ছা-অবসরের। এ কারণে সম্পর্কে ভাটা পড়ে মমতার সঙ্গে। জোরালো হয় মুকুল রায়ের সঙ্গে সম্পর্ক। শুরু হয় ভারতী ঘোষকে নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে নতুন রাজনীতি।
ভারতী ঘোষকে নাস্তানাবুদ করার জন্য মামলা হয়। মামলা করেন পশ্চিম মেদিনীপুরের স্বর্ণ ব্যবসায়ী চন্দন মাজি। চন্দন মাজি অভিযোগ করেন, ভারতী ঘোষ হুমকি দিয়ে চাঁদা আদায় করতেন। টাকা ও সোনা আদায় করা ছিল তাঁর লক্ষ্য। এই অভিযোগ নিয়ে শুরু হয় তদন্ত।
কলকাতার সিআইডি পুলিশও বসে নেই। ভারতী ঘোষের অবৈধ সম্পত্তির খোঁজে নেমে পড়ে তারাও। ৫ ফেব্রুয়ারি তল্লাশি চালানো হয় কলকাতার আনন্দপুরে ভারতী ঘোষের তিনটি বাড়িতে। সিআইডি ৬ ফেব্রুয়ারি এই তল্লাশির পর দাবি করে, তাঁর আস্তানা থেকে উদ্ধার হয়েছে নগদ আড়াই কোটি টাকার নতুন নোট। এ ছাড়া অন্যান্য সামগ্রী। তল্লাশির সময় ভারতী ঘোষ বাড়িতে ছিলেন না। সিআইডি ইতিমধ্যে ভারতী ঘোষের বিরুদ্ধে নোটিশ জারি করে ১০ ফেব্রুয়ারি কলকাতার সিআইডি হেড কোয়ার্টার ভবানী ভবনে উপস্থিত হওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। শুধু এখানে থেমে যায়নি মামলার গতি। মামলা চলছে ভারতী ঘোষের বিরুদ্ধে। বুধবার উত্তর ২৪ পরগনার স্বরূপনগরের ব্যবসায়ী ইউনুস আলী মণ্ডল করেন ভারতী ঘোষের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের আরেকটি মামলা। অভিযোগ রয়েছে, ২০১৬ সালে পশ্চিম মেদিনীপুরের খড়গপুরে একটি গাড়ি দুর্ঘটনায় ইউনুস গুরুতর আহত হন। তখন ওই গাড়িতে থাকা তাঁর ৪৫ লাখ রুপি হাওয়া করে দেন পুলিশ সুপার ভারতী ঘোষ ও তাঁর সাঙ্গপাঙ্গ পুলিশের সদস্যরা। ভারতী ঘোষ তখন পশ্চিম মেদিনীপুরের পুলিশ সুপার ছিলেন।
বসে নেই ভারতী ঘোষও। ৫ ফেব্রুয়ারি ভারতী ঘোষ ও তাঁর স্বামী এই ঘটনার সিবিআই তদন্তের দাবিতে কলকাতা হাইকোর্টে একটি জনস্বার্থ মামলা করেছে। যে মুখ্যমন্ত্রী ভারতী ঘোষকে দীর্ঘদিন নিজে আগলে রেখে পশ্চিম মেদিনীপুরের নিয়োগ করে সেখানের মাওবাদী আন্দোলন দমন করেছেন, যে মুখ্যমন্ত্রীকে এই ভারতী ঘোষ ‘মা’ বলে ডেকেছেন, সেই ভারতী ঘোষকে নিয়ে হঠাৎ পাল্টে গেলেন কেন মমতা? রাজনৈতিক মহলের খবর, ভারতী ঘোষের সঙ্গে মুকুল রায়ের ঘনিষ্ঠতা এবং তৃণমূলের মেদিনীপুরের প্রভাবশালী এক মন্ত্রীর সম্পর্কে ফাটলই ভারতী ঘোষের বিরুদ্ধে গোসা হওয়ার কারণ তৃণমূল নেতৃত্বের।
এখন এই ভারতী ঘোষকে বিজেপিতে নেওয়ার জন্য তৎপরতা শুরু করেছে বিজেপি নেতৃত্ব। সংবাদমাধ্যমের খবর, ইতিমধ্যে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতা কৈলাস বিজয় বর্গীয় এবং রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষের সঙ্গে বৈঠকও করেছেন ভারতী ঘোষ। দিলীপ ঘোষ বলেছেন, যে কেউ বিজেপির আদর্শে বিশ্বাসী হয়ে দলে আসতে পারেন। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরাও মনে করছেন, যেভাবে ভারতী ঘোষের ওপর রাজ্য সরকারের তরফে চাপ বাড়ছে। সে ক্ষেত্রে ভারতী ঘোষকে এই চাপ থেকে বাঁচতে তাঁকে একটি দলে যোগ দিতে বাধ্য করা হতে পারে। আর এ ক্ষেত্রে বিজেপি ছাড়া ভারতী ঘোষের দ্বিতীয় পথ খোলা নেই। কারণ, এখন দিল্লির শাসনক্ষমতায় বিজেপি। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, ভারতী ঘোষ কি রেহাই পাবেন দুর্নীতির এই অভিযোগ থেকে? নাকি বিজেপিতে যোগ দিয়ে মমতাবিরোধী অস্ত্র হবেন?